কখনও কি আমাকে ছেড়ে যাবে তুমি ?

চারিদিকে অদ্ভুত বিষন্নতা, নিরবতার চাঁদরে ঢাকা পড়ে আছে ম্রিয়মান চারিপাশ, কোলাহল থেমে গেছে, অসীম অন্ধকার যেন গিলে খাচ্ছে সম্ভবনার শেষ আলোটুকু, রঙ চটা পুরনো দেয়ালে ঝুলে থাকা কৃতদাস দেয়াল ঘড়িটা পরম বিশ্বস্ততার সাথে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে চলেছে অবিরাম। ঢং ঢং ঢং করে সময় চলে যাচ্ছে সীমাহীন শূন্যতায়। আর কালি জমা মাকড়সা জালে ক্রমান্বয়ে আটকে পড়ছে বাস্তবতা। প্রতিদিনের বাস্তবতা।

গোধূলীর আলো ম্লান করে দূরে কোথাও বেজে উঠল গির্জার ঘন্টা, পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে, লবনাক্ত ঘামের শেওলা জমা শরীরে ক্লান্তির বোঝা, পাহাড়ী পথের ঢাল বেয়ে কারখানার শ্রমিকেরা ডেরায় ফিরছে, চোখ ভরা বিষন্নতার স্বপ্ন।

তবু দিন শেষে ঘরে ফেরার এই আনন্দে-উৎকট গন্ধ গায়ে মেখে, নেশাচুর রক্তলাল ঢুলু-ঢুলু চোখে অনাগত আগামীর বিবর্ণ ধূসর বেঁচে থাকার মলিন আর্তনাদ।

সে আর্তনাদ গান হয়ে বেজে ওঠে।

সত্যিই কি গান? নাকি মাতম? প্রতিদিন নিজেকে হারিয়ে ফেলার মাতম, প্রতিদিন একটু একটু করে অথচ নিশ্চিত ফুরিয়ে যাওয়ার মাতম।

যাই হোক; তবু বেজে ওঠে গান, বুকের গহিন থেকে বেরিয়ে আসে সুর

“হামাক জানি না যাও ছাড়ি

রঙ্গিলা পাহাড়ি ?

বুকের মাঝে বান্ধ্যি রাইখ

আদর-সোহাগ করি”……………….।

আর এভাবেই প্রতিদিন পাহাড়ের পাদপিঠে অজস্র কষ্টের সুর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে বুকের ভেতর, সহসা প্রশ্ন করি নিজেকে নিজে –

তুমি কি কখনও ছেড়ে যাবে আমাকে ?

নিশ্চুপ !

তুমি কি কখনও ছেড়ে যাবে আমাকে?

নিরবতা !

তুমি কি কখনও ছেড়ে যাবে আমাকে?

উওর আসে না কোন, শব্দহীন প্রশ্নগুলো রঙ চটা দেয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে না, বুকের ঘরে অদৃশ্য দেয়ালে কান্নার স্মৃতি হয়ে লেপ্টে থাকে, বর্ণহীন, গন্ধহীন, শুধু যেন নিশ্চুপ নিরবতা শূন্যতা।

প্রশ্নটা যে খুবই সহজ, উত্তরও আছে জানা।

আচ্ছা উত্তর পরে হবে, তার আগে একটু ভেবে দেখি, মনে করার চেষ্টা করি এই কথাটা আসলে আমরা কতভাবে ব্যবহার করে থাকি।

আসলে যতো ভাবেই বলিনা কেন, সাধারনত খুব কাছের মানুষকে, খুব প্রিয়

কাউকেই আমরা বলে থাকি, “কখনও কি আমাকে ছেড়ে যাবে তুমি” ?

এবং সব সময় উওর না হয়, আসলে পৃথিবীর সমস্ত ভাষা ব্যবহারের এই জায়গাটিতে চরম সত্যটি লুকিয়ে থাকে, সত্যটা স্বীকার করি না।

কিন্তু সত্য কি? সত্যটা আসলে খুব নির্মম, প্রতিশ্রুতি দেয়া প্রিয়জনগুলো দূরে সরে যায়, আপন মানুষগুলো হয়ে যায় পর।

আর যদি প্রশ্নটা নিজেকেই করা হয়, নিজের অন্তর পাখি।উত্তরটা জানা আছে, কিন্তু মেনে নিতে অনেক কষ্ট, অন্তর পাখিও একদিন উড়ে যায়, ছেড়ে যায় দেহ খাঁচা, সারা বেলা-সারাক্ষন তাই অদৃশ্য ভয় এর সাথে বসবাস। পাখি আমার একলা পাখি, ইচ্ছে হলেই দূর আকাশে একলা একা উড়া-উড়ি, আপন ডানা, আপন খাঁচা, ছেড়ে সকল আপন মায়া, কোথা যাও উড়ে, পাখি আমার তোমার বিহনে মনটা কেমন করে।

হ্যাঁ; এটাই সত্য, সবাই চলে যায় এসে, কিছু আগে পরে, তাহলে আর কার সাথে এই প্রশ্নের বোঝাপড়া, কার সাথে?

“কখনও কি আমাকে ছেড়ে যাবে তুমি”

আচ্ছা; প্রশ্নটা যদি দয়াময় সৃষ্টিকর্তাকে করা হয়- উওর কি হবে?

উওরটাও খুব পরিস্কার, তিনি কখনও আমাদেরকে ছেড়ে যান না, তিনি কখনই আমাদের পরিত্যাগ করেন না।

কিন্তু আমরা কতটুকু তার সাথে আছি? কতবার তার কাছে আত্মসমর্পন করেছি? কতবার ভাবছি তাকে নিয়ে? একটি চারাগাছ থেকে ফল পেতে হলে যেমন অনেক পরিচর্যা করতে হয়, তেমনি একটি স্বাস্থ্যবান সম্পর্ক নির্ভর করে পারস্পরিক সমঝোতায়, যদি পরিচর্যা না থাকে, যদি সমঝতা না থাকে সম্পর্কের রং ফিকে হয়ে যেতে পারে, মরে যেতে পারে গাছ, দূর থেকে বহু দুরে সরে যেতে পারে প্রিয়জন, আর বান্দা যখন জেনে-বুঝে ভুল করতে থাকে, নিজেকে জড়িয়ে ফেলে মন্দতার চাঁদরে, তখন দুরত্ব তৈরী হতে থাকে, কিন্তু দয়াময় তিনি আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন না, বরং অপেক্ষাতে থাকেন, কখন তার প্রিয় বান্দা ক্ষমা প্রার্থনাতে নত হবে।

চেনা আঙিনাগুলো অচেনা লাগে, অস্থির সময় এসে গ্রাস করে নিতে চায় সমস্ত উদ্দীপনা, বেঁচে থাকার রং বড় ফ্যাকাসে হয়ে যায়, অস্তগামী সূর্যটা যেন জীবনের শেষ আলোটুকু চুরি করে নিয়ে যায় প্রতিদিন। ফেরা হয় না, আমার ফেরা হয় না, ফেরা হয় না বিধাতা তোমার কাছে, যে তুমি কখনই ছেড়ে যাবে না আমাকে, যে তুমি কখনই পরিত্যাগ করবে না আমাকে।

দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং ঢং শব্দ করে অস্তিত্ব জানান দেয় আবার, হঠাৎ চেতনা ফিরে আসে, আমি সহসা বুঝতে পারি, অজস্র কাল ধরে আমি তোমার পানে ছুটে চলেছি, অজস্র পথ দিতে চাইছি পাড়ি-তবু আমার অসার বিবেকের বন্ধ দড়জা খুলে আমি বেরিয়ে আসতে পারি নি, তবু, তবুও তুমি কখনই আমাকে ছেড়ে যাও নি, কখনও কর নি পরিত্যাগ।

Follow me

You may also like...