কিসে ধনী হতে চাও?

হরিপদ দাস, বাবা ছিলেন পৈতৃক সূত্রে শেষ জমিদার হরিপ্রতাপ দাস। শেষ বলতে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যা ছিল তা নামতে-নামতে শেষে এসে ভিটে ছাড়া অবস্থা। জমিদারী ফুরাতে ফুরাতে চরম অভাবের মধ্যেই জমিদারের রোগাক্লিষ্ট বৃদ্ধা বউ পোয়াতি হলেন। তাদের ঘরে প্রথম সন্তান এলো, চারিদিকে আনন্দের বাদ্য বাজার কথা, এলাকা জুড়ে আনন্দ-উৎসব হবার কথা, কিন্তু কিছুই হলো না, হরিপ্রতাপ তার শেষ প্রতাপ খাটিয়ে সাত গাঁও খুঁজে এক বুড়ো দাই-কে নিয়ে এসে দায়ের কাজটা শেষ করলেন, তার এই দুঃখের দিনে ছেলের নামের থেকে অনেকটা অভিমানে প্রতাপের পদবি উঠিয়ে হরিপদ রাখলেন। এই বৃদ্ধ বয়সে বাবা হবার যে আনন্দ তা তিনি কিছুই অনুধাবন করতে পারলেন না, গেরুয়া পরে বনে-বাদারে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, ঘুরে-ঘুরে অবশেষে আর ফিরে এলেন না।

প্রচন্ড অভাবের মধ্যে বড় হতে লাগল হরিপদ দাস। পড়াশোনা এগোলো না, সারা দিন একতারা হাতে বাউল ফকিরের পিছু-পিছু ঘুরে বেড়ায়, অসুস্থ মা ধুঁকে-ধুঁকে একদিন দেহত্যাগ করলেন, মুখে অগ্নি দিয়ে সেই যে পথে নেমেছে হরিপদ, তারপর থেকে বিরামহীন শুধু ছুটে চলছে, চলছে আর চলছে, এর যেন শেষ নেই। গানের বেশ দরদী গলা, তাই পথে-ঘাটে যেখানেই যায় হরিপদ- সেখানেই এক অনুরোধ, একটা গান ধরো তো হরিদা।

হরিপদ গলা ছেড়ে গান ধরে, অর্থ-কড়ি, ধন-সম্পত্তি কিছুই রবে না, ডাক আসিলে যেতে হবে ছাড়িয়া সব মায়া………..।

হরিপদ অভাবের তাড়নাতে সব হারাতে হারাতে বাবার দেয়া অভিমানের পদবি অর্থাৎ “পদ” টাও হারাতে বসেছে, কেউ আর হরিপদ বলে ডাকে না। হরিদা বলে ডাকে, তার ভালোই লাগে, আশপাশে তার একটু নাম ডাক হয়েছে, গানের জন্য ডাক আসে, নিজের এক তারার সাথে যন্ত্রীরাও কাজ করে।

মায়াপুর, নদীর পারে ছোট্ট গ্রাম, হাট বসেছে, প্রতি মঙ্গলবার এখানে হাট বসে। নানান রঙ্গের মানুষ আসে, বেচা-কেনা হয়, কিছু মনোহরি দোকান, চায়ের দোকান, গাঁও-গেরামে এখন বিদ্যুত এসেছে, চায়ের দোকানে টেলিভিশন চলে, লোকজনের ভিড় বাড়ে, বেচা-বিক্রি ভাল হয়।

হারু মাঝি, আগে নাম ছিল তার হারুন মাঝি, চায়ের দোকানে চা বানাতে ব্যস্ত, হাটবারে লোকজন বেশি থাকে বলে তার সাত বছরের ছেলে নারু প্রতি হাট বারে বাবাকে সাহায্য করতে চলে আসে, হারু মাঝির বয়স পঞ্চাশের কাছা-কাছি, ভরা নদীতে তুমুল উদ্দামে বৈঠা চালাত, এখন নদীতে ইঞ্জিনের নৌকা চলে, হারুন মাঝি তাদের সাথে পেরে ওঠে না, ইঞ্জিনের নৌকার কাছে বারে বারে হেরে য়ায়, লোক জন তাই হারুন মাঝিকে হারু মাঝি বলে ডাকা শুরু করল।

হারু মাঝি কিন্তু হেরে যাবার অথবা ছেড়ে দেবার পাত্র না, সে চায়ের দোকান করেছে, হরিপদকে গুরু মেনে তার দলে ভিড়ে গেছে যন্ত্রি হিসাবে, আসমানে যখন পূর্নিমা ওঠে হারুন মাঝি তার নৌকা নিয়ে গানের দল নিয়ে মাঝ গাঙ্গে চলে যায়, তারপর হরিপদকে বলে গান ধরো। হরিপদ গান ধরে, আসমান ভরা জ্যোৎস্না-তারা, গাঙ্গে ভরা ঢেউ, আমার পরান দুঃখে কান্দে, দেখল না তো কেউ…………

 

হাট বেলা প্রায় শেষের পথে, ভিড় এখন হারুনের চায়ের দোকানে, টিভিতে খবর শেষ হয়েছে মাত্র, সবার মাঝে চাপা উত্তেজনা, একটা অস্বস্থি, কেউ বুঝে উঠতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা হ্যাক হয়েছে মানেটা কি? তাও আবার এক কুড়ি দুই কুড়ি না, আটশো কোটি টাকা। কেউ বুঝতে পারছে না আটশো “কোটি টেকা মানে কয় কুড়ি টাকা? তাও আবার হ্যাক করা হয়েছে, এই হ্যাক মানেডা কি?” সবাই এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।

গ্রামের মাতব্বর গরম চায়ের ধোঁয়া-ওঠা কাপে চুমুক দিয়ে সবার হয়ে প্রশ্ন করলেন মায়াপুর প্রাইমারী স্কুলের শুকুর আলী হেড মাষ্টারকে। “আচ্ছা মাষ্টার এই যে এতো টাকা হ্যাক হয়েছে, এর মানেডা কি? এতো টেকা দিয়ে মানুষ কি করে? মানুষের সুখ-শান্তির জন্যি কত টেকা দরকার হয় বুলতি পারেন?”

শুকুর মাষ্টার, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর, অভাব দৈন্যতার সাথে নিত্য বসবাস। বাড়িতে তার সব হাঁ করা মুখ, সবারই শুধু চাওয়ার অসুখ। তবু এরই মাঝে সে স্কুলে বাচ্চাদের শিক্ষা দেয় প্রতিদিন – এই দুনিয়াতে তোমরা নিজেদের জন্য ধন-সম্পদ জমা করো না। এখানে মরচে ধরে ও পোকায় নষ্ট করে এবং চোর এসে চুরি করে। কিন্তু তোমরা আল্লাহ্র রাজ্যের বিষয়ে ও তাঁর ইচ্ছেমত চলার জন্য ব্যস্ত হও। তাহলে ওই সব জিনিসও তোমরা পাবে। কালকের বিষয়ে চিন্তা করো না‌।

মাতব্বরের ডাক শুনে শুকুর মাষ্টার এবার সবার মুখে চোখ ঘুরিয়ে বলতে থাকে, ”আট শো কোটি টাকা মানে তোমাদের কুড়ির হিসাবে বুঝানো সম্ভব না, আর চুরি করা যা, ওই হ্যাক করা একই বিষয়, আমরা গাঁও-গেরামের গরীব-দুঃখী মানুষ, এসবের খবর রেখে আর কি হবে? সেই ২০১২ সালের কথা তোমাদের মনে আছে? হলমার্কের অর্থ কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করল, তাছাড়া  ভুয়া এলসি খুলে আরও ৪০টি কোম্পানির নামে তুলে নিল ১ হাজার কোটি টাকা।

 

এবার আস বেসিক ব্যাংকে। টাকার অঙ্ক ৩৫০০ কোটি টাকা। আর সেখানেও সেই একই ব্যাপার, ব্যাংকের লোক জড়িত। হলমার্ক কেলেঙ্কারী ফাঁস হবার পর অর্থমন্ত্রী বললেন এতবড় বাজেটে এটা খুব বড় বিষয় নয়। আবার এখন শুনছি ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমান ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪৮ কোটি ২১ লাখ। যেখানে এত টাকা মানুষ খায়ে-দায়ে হজম করি ফেলাচ্ছে, সেকেনে তুমরা আছো এক কুড়ি- দুই কুড়ির হিসাবে।

 

শোন মানুষের ধন যেখানে থাকে তার মন সেখানে থাকে, এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিসে তুমি ধনী হতি চাও? এখানে জীবন ক্ষনিকের, আখেরাতের জন্য তোমার ধন সঞ্চয় কর, মন্দ উপায়ে ধনী হতে যেও না। ভালোর সাথে চলো ।

এবার গ্রামের রোগাক্লিষ্ট মুর্খ লোকেরা, অভাব গ্রস্ত লোকেরা মাতম করতে থাকে “ও খোদা এতো গুলো টাকা ওরা কি কল্লো, কি কল্লো? ধনী হওয়া মানে কত টেকা, সুখ-শান্তি খরিদ করতি কত টেকা লাগে মানুষের? ওরে মানুষ, ওরে রঙ্গের মানুষ।

 

এরই মাঝে সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিমে, বিদ্যুত চলে গেছে, ঘুট-ঘুটে এক অদ্ভুত আঁধার চারিদিকে, সহসা চেনা পথঘাট অচেনা লাগে, জোনাক জ্বলে-জোনাক নিভে যায়, ঢেউয়ের পরে ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ। হয়ত আজ রাতেই এই নদী গ্রাস করে নেবে আরও কিছু আবাদী ফসলের ভূঁই, কারও বসত-ভিটা, অগণিত স্বপ্ন। ঢেউ ভাঙ্গছে তো ভাঙ্গছে, অদ্ভুত এক জ্যোৎস্না এসে তবু ঢেউয়ে জলে মাখা-মাখি করছে।

হরিপদ গান ধরে— কিসের ধনে ধনী হবা,

যা বুনিবা তাই পাবা।

জগত-সংসার সবই অসার,

খুঁজে দেখ সত্য পাবা,

মন…রে কিসের ধনে ধনী হবা।

Follow me

You may also like...